রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থ – জীবনানন্দ দাশ ( ১৯৫৭ )

রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থ বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশের সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। এটি তাঁর সপ্তম কাব্যগ্রন্থ। কবি জীবদ্দশায় এ গ্রন্থটি বা এর অন্তর্ভুক্ত কোন কবিতা প্রকাশ করেন নি। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে দুঘর্টনায় অকালমৃত্যুর পর এর পাণ্ডুলিপির খাতাটি আবিষ্কৃত হয়। কবি এ গ্রন্থটির প্রচ্ছদনাম নির্বাচন করেছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা। জীবনানন্দ কেন স্বীয় জীবদ্দশায় এ কাব্যগন্থটি প্রকাশ করেননি তা অদ্যাবধি এক পরম বিস্ময় হয়ে আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এ কাব্যের কবিতাগুলি বাঙালিদের বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল

রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থ – জীবনানন্দ দাশ ( ১৯৫৭ )

প্রকাশনা তথ্যাদি:

রূপসী বাংলা কাব্যসংকলনটির প্রথম প্রকাশ ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। প্রকাশক সিগনেট প্রেস, কলকাতা। প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি সংস্করণ প্রকাশ করে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো এই যে জীবনানন্দ তার জীবদ্দশায় এ গ্রন্থটি বা এর অন্তর্ভুক্ত কোন কবিতা প্রকাশ করেন নি। মৃত্যুর পর এর পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপির খাতা আবিষ্কৃত হয়। পাণ্ডলিপিটি সম্পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায়। তবে প্রথম মুদ্রণার্থে লেখার খাতা থেকে প্রেসকপি তৈরী করে ছিলেন কবি ভূমেন্দ্র গুহ; তাকে সাহায্য করেছিরেন জীবনানন্দ’র ছোট বোন সুচরিতা দাশ।

 

রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থ - জীবনানন্দ দাশ ( ১৯৫৭ )

 

কবিতাসূচী:

সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি
তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও—আমি এই বাংলার পারে
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর র‍ূপ
যত দিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে
এক দিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
কোথাও দেখি নি, আহা, এমন বিজন ঘাস—প্রান্তরের পারে
হায় পাখি, একদিন কালীদহে ছিলে না কি—দহের বাতাসে
জীবন অথবা মৃত্যু চোখে র’বে—আর এই বাংলার ঘাস
যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে—দূর কুয়াশায়
পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত কোনখানে সফলতা শক্তির ভিতর,
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে;
যখন মৃত্যুর ঘুমে শ‍ুয়ে র’ব—অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে—এই বাংলায়
যদি আমি ঝ’রে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়:
মনে হয় একদিন আকাশের শ‍ুকতারা দেখিব না আর
যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়—সে তো আর ফিরে নাহি আসে
কোথাও চলিয়া যাব একদিন;—তারপর রাত্রির আকাশ
তোমার বুকের থেকে একদিন চ’লে যাবে তোমার সন্তান
গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায়
অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে
ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর—চিল একা নদীটির পাশে
খুঁজে তারে মর মিছে—পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
পাড়াগাঁর দু’-পহর ভালোবাসি—রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে আছে
কখন সোনার রোদ নিভে গেছে—অবিরল শুপুরির সারি
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে—সব চেয়ে সুন্দর করুণ:
কত ভোরে—দু’-পহরে—সন্ধ্যায় দেখি নীল শুপুরির বন
এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে
এখানে আকাশ নীল—নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
কোথাও মঠের কাছে—যেইখানে ভাঙা মঠ নীল হয়ে আছে
চ’লে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে—জামরুলে হিজলের বনে;
এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্ণে শান্তি আসে মানুষের মনে;
শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ—বহুকাল গেয়ে গেছ গান
তবু তাহা ভুল জানি, রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা;
সোনার খাঁচার বুকে রহিব না আমি আর শুকের মতন;
কত দিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দু’জনে;
এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি ব’সে নিজ মনে একা;
কত দিন তুমি আর আমি এসে এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর
এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায়—সন্ধ্যায় ঘুমায় নীরবে
একদিন যদি আমি কোনো দূর মান্দ্রাজের সমুদ্রের জলে
দূর পৃথিবীর গন্ধে ভ’রে ওঠে আমার এ বাঙালীর মন
অশ্বত্থ বটের পথে অনেক হয়েছি আমি তোমাদের সাথী;
ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীর—
এই জল ভালো লাগে;—বৃষ্টির র‍ূপালি জল কত দিন এসে
একদিন পৃথিবীর পথে আমি ফলিয়াছি; আমার শরীর
পৃথিবীর পথে আমি বহ‍ুদিন বাস ক’রে হৃদরের নরম কাতর
মানুষের ব্যথা আমি পেয়ে গেছি পৃথিবীর পথে এসে—হাসির আস্বাদ
তুমি কেন বহ‍ু দূরে—ঢের দূরে—আরো দূরে—নক্ষত্রের অস্পষ্ট আকাশ,
আমাদের র‍ূঢ় কথা শ‍ুনে তুমি স’রে যাও আরো দূরে বুঝি নীলাকাশ;
এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শ‍ুধু আসিয়াছি—আমি হৃষ্ট কবি
বাতাসে ধানের শব্দ শ‍ুনিয়াছি—ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্ণ ভ’রে;
একদিন এই দেহ ঘাস থেকে ধানের আঘ্রাণ থেকে এই বাংলার
আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক—পুকুরের জলে
হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয়—চিতা শ‍ুধু প’ড়ে থাকে তার,
কোনোদিন দেখিব না তারে আমি; হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
ঘাসের ভিতরে যেই চড়ায়ের শাদা ডিম ভেঙে আছে—আমি ভালোবাসি
(এই সব ভালো লাগে): জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে
সন্ধ্যা হয়—চারিদিকে শান্ত নীরবতা;
একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
ভেবে ভেবে ব্যথা পাব;—মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকিতাম বেঁচে

 

জীবনানন্দ দাশ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক৷ তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম৷ তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মিলে৷ জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল, ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হয়েছেন ৷

আরও দেখুন:

2 thoughts on “রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থ – জীবনানন্দ দাশ ( ১৯৫৭ )”

Leave a Comment