মহাভারত: এক মহাকাব্যিক আখ্যানের আদ্যোপান্ত। বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বিস্তৃত মহাকাব্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, বরং এক বিশাল সাহিত্যকর্ম যা ধর্ম, নৈতিকতা, রাজনীতি, যুদ্ধ, এবং মানবিক সম্পর্কের একটি সমৃদ্ধ চিত্র তুলে ধরে। মহাকাব্যটি ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ইতিহাসে এক গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং এর প্রতিফলন আজও সমাজের বিভিন্ন স্তরে দেখা যায়।
মহাভারত: এক মহাকাব্যিক আখ্যানের আদ্যোপান্ত
মহাভারতের উৎপত্তি ও রচনা
মহাভারতের রচয়িতা হিসেবে মহর্ষি ব্যাসদেবকে গণ্য করা হয়। বলা হয়, ব্যাসদেবের নির্দেশনায় গণেশ এই মহাকাব্যটি লিপিবদ্ধ করেন। মহাভারত প্রায় ১ লক্ষ শ্লোক নিয়ে গঠিত, যা মহাকাব্যটিকে বিশ্বের বৃহত্তম সাহিত্যিক কাজগুলোর একটি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মহাভারতের রচনা সময়কাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে এটি খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে খ্রিস্টীয় ৪০০ সালের মধ্যে রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
মহাভারতের কাঠামো
মহাভারত ১৮টি পর্ব বা পার্বে বিভক্ত, যেগুলোকে সমগ্র মহাকাব্যের বিভিন্ন অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রতিটি পর্বে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী এবং শিক্ষা বর্ণিত হয়েছে, যা একত্রিত হয়ে মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ রূপ গঠন করেছে।
১. আদিপর্ব: মহাভারতের প্রথম পর্ব, যেখানে কৌরব ও পাণ্ডবদের বংশ এবং তাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।
২. সভাপর্ব: এই পর্বে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ, কৌরবদের দ্বারা দ্রৌপদীর অপমান এবং পাণ্ডবদের নির্বাসনের বর্ণনা রয়েছে।
৩. অরণ্যপর্ব: পাণ্ডবদের ১২ বছরের বনবাসের সময়কাল নিয়ে এই পর্বে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
৪. বিরাটপর্ব: পাণ্ডবদের এক বছরের অজ্ঞাতবাসের বর্ণনা করা হয়েছে এই পর্বে।
৫. উদ্যোগপর্ব: কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে প্রস্তুতি এবং যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে এই পর্বটি গঠিত।
৬. ভীষ্মপর্ব: কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে প্রথম ১০ দিনের বর্ণনা, যেখানে ভীষ্ম সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
৭. দ্রোণপর্ব: দ্রোণাচার্য যখন সেনাপতি হন এবং যুদ্ধে গুরুকুলের বিভিন্ন ছাত্রদের মুখোমুখি হতে হয়।
৮. কর্ণপর্ব: কর্ণ সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের বর্ণনা দেয়া হয়।
৯. শল্যপর্ব: শল্য সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন এবং যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা এখানে বর্ণিত হয়েছে।
১০. সৌপ্তিকপর্ব: কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুষাসন এবং দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রদের হত্যার বর্ণনা দেয়া হয়।
১১. স্ত্রীপর্ব: যুদ্ধে নিহত কৌরব এবং পাণ্ডবদের স্ত্রীদের শোক এবং আক্ষেপের বর্ণনা।
১২. শান্তিপর্ব: যুদ্ধে বিজয়ের পর যুধিষ্ঠিরের রাজ্য পরিচালনা এবং ভীষ্মের শয্যা পর্বের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
১৩. অনুশাসনপর্ব: ভীষ্মের নির্দেশনা এবং নৈতিকতা, ধর্ম, এবং রাজনীতির বিষয়ে তাঁর উপদেশ বর্ণনা করা হয়েছে।
১৪. আশ্রমবসিকপর্ব: যুধিষ্ঠিরের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য হস্তিনাপুর ত্যাগ এবং বনবাসের বর্ণনা।
১৫. মৌসলপর্ব: যদুবংশের ধ্বংস এবং কৃষ্ণের মহাপ্রয়াণ বর্ণনা করা হয়েছে।
১৬. মহাপ্রস্থানিকপর্ব: পাণ্ডবদের হিমালয়ে মহাপ্রস্থানের বর্ণনা।
১৭. স্বর্গারোহণিকপর্ব: স্বর্গারোহণ এবং স্বর্গের দৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে এই পর্বে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ এবং গীতা
মহাভারতের মূল কেন্দ্রীয় কাহিনী হল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, যা কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মহাকাব্যটি মানব জীবনের বিভিন্ন দিককে তুলে ধরে, যেমন নৈতিকতা, ধর্ম, রাজনীতি, ক্ষমতা, এবং ধৈর্য।
যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুন, যিনি পাণ্ডবদের অন্যতম বীর, যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানান। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে পরামর্শ দেন এবং এই পরামর্শ মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা” নামে পরিচিত। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কর্ম, ধর্ম, এবং মোক্ষের মূলনীতি শেখান। এটি শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং নৈতিকতার শিক্ষা এবং জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে।
মহাভারতের শিক্ষা এবং প্রভাব
মহাভারত শুধুমাত্র একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি মানব জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে শিক্ষণীয় বার্তা প্রদান করে। এতে ক্ষমতার লোভ, প্রতিহিংসা, ধর্মীয় দায়িত্ব, এবং মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ রয়েছে।
১. নৈতিকতা ও ধর্ম: মহাভারত প্রতিটি চরিত্রের মাধ্যমে নৈতিকতা এবং ধর্মের গুরুত্ব বোঝায়। যুধিষ্ঠিরের চরিত্র ধর্মের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে দুর্যোধন ক্ষমতার লোভের প্রতীক।
২. ক্ষমতা ও প্রতিহিংসা: মহাভারত দেখায় যে প্রতিহিংসা এবং ক্ষমতার লোভ কিভাবে পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ তার প্রমাণ।
৩. মানবিক সম্পর্ক: মহাভারত পরিবার, বন্ধু, এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব এবং সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করে। এটি দেখায় যে কীভাবে পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি একটি পুরো সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে।
মহাভারত শুধু একটি মহাকাব্য নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সমাজের গভীরে প্রোথিত এক শিক্ষণীয় সাহিত্যকর্ম। এর প্রতিটি চরিত্র, কাহিনী, এবং শিক্ষা মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত করে। মহাভারতের শিক্ষা শুধুমাত্র প্রাচীন ভারতের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এর শিক্ষা, নৈতিকতা, এবং নীতিবোধ আজও প্রাসঙ্গিক এবং ভবিষ্যতেও তা প্রভাব ফেলবে।
আরও দেখুনঃ